A review by musa
কত অজানারে by Sankar

5.0

আইনপাড়া, অর্থাৎ কোর্ট-কাছারি-আদালত সম্বন্ধে আপনার ধারণা কি? সামান্য ধারণা পেয়ে আমার যা মনে হলো, এখানে পুরোদস্তুর ডিবেট চলে! জজ থাকেন স্পিকার, কখনো তার সাথে সহায়তায় জুরিরা, আর বাদী হোক বা আসামী- যার যার পক্ষের উকিল ব্যারিস্টার তার মক্কেলকে ষোলোআনা সাফ জানেন, "All my geese are swan, আমার সব কানা ছেলেই পদ্মলোচন।" কাড়ি কাড়ি বই আর রেফারেন্স নিয়ে তর্ক করে যান দুই ব্যারিস্টার, টাইম কিপার বা ফ্লোর ম্যানেজারের মতো ব্যারিস্টারদের সহকারীরা সেই তর্ক সচল রাখতে যা করার করেন। দিনশেষে কোনো বিরোধ নেই, রায় যেদিকেই হোত হাত মিলিয়ে ব্যারিস্টাররা বেরিয়ে যান পরের দিনের জন্য। বাংলা সিনেমার মতন একদমই না।
বইয়ের প্রাণচরিত্র নোয়েল ফ্রেডরিখ বারওয়েল ছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের শেষ ইংরেজ ব্যারিস্টার। বই থেকে, "অনেকে ভাবে এ পাড়ায় আইনের নামে যত রাজ্যের বে-আইনী কাজ হয়। উকিলেরা মিথ্যা কথা বলে, এটর্নিরা সুযোগ পেলেই মক্কেলকে শোষে। ভাই-এ ভাই-এ মোকাদ্দমায় দুইজনেই পথে বসে, মাঝখান দিয়ে এটর্নিরা কলকাতায় বাড়ি তোলে। কথাগুলো যে সবসময় মিথ্যা তা নয়, কিন্তু সবাই এখানে কিছু চোর ডাকাত নয়। এখানে অনেক মানুষ আছেন যারা জীবনে কখনো মিথ্যার আশ্রয় নেননি। সততাই তাদের জীবনের একমাত্র মূলধন। উড্রফ, স্যার গ্রিফিথ ইভান্স, উইলিয়াম জ্যাকসনের মত আইনিবিদরা যে কীর্তি রেখে গেছেন, আমাদের বারওয়েল সায়েব তার শেষ বর্তিকাবাহী। কলকাতা হাইকোর্টের শেষ ইংরেজ ব্যারিস্টার। অষ্টাদশ শতাব্দীতে যার শুরু, বিংশ শতাব্দীর মধ্যাহ্নে যার অবসান।"
বাংলা সাহিত্যে শিবরাম চক্রবর্তী আর শংকরকে আমি আলাদা শ্রদ্ধার আসনে দেখি। পেশায় তারা সম্মানের স্থানে ছিলেন না, তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীর আসনে থেকেও নিজ জায়গায় বসে জীবনকে সমঝদারের চোখে দেখে গেছেন, আর মুখে হাসি ধরে রেখে আমাদেরও দিয়েছেন অমূল্য সাহিত্য সম্ভার। প্রথম চাকরিজীবনে শংকর ছিলেন ব্যারিস্টারের সহকারী, চলতি কথায়, 'বাবু'। ওল্ড পোস্ট অফিস স্ট্রিটের কলকাতা হাইকোর্টে যদ্দিন ছিলেন, নিবিড় পর্যবেক্ষণে জীবনকে দেখে তার সাহিত্যিক বহিঃপ্রকাশ করেছেন। জীবনের এ নানা রং দেখানোয় কখনো ঝুলি খুলে বসেছেন ব্যারিস্টার বারওয়েল নিজে, কখনো আগত মক্কেলদের জবানবন্দিই সহায়।
'কত অজানারে' যে সময়ের রচনা, তখন ভারতবর্ষে ঠিক ইংরেজ বিচরণ লক্ষ্য করা যায় না। যারা তবু আছেন, ছিলেন দীর্ঘকাল থেকে যাওয়ার খেই ধরে নানারকম স্মৃতির সাথেই।
বইয়ের শুরুতে এক মক্কেলের সন্ধান পাই আমরা, মেরিয়ন স্টুয়ার্ট, লেবাননে জন্ম। মা তার দুর্ভাগ্যে আদিম পেশাটি বেছে নিলেও মেয়েকে নিরাপদ রাখতে চেয়ে তাকে 'আভা স্টুয়ার্ট' নামে পাত্রস্থ করতে চান। প্রথম জীবনে লেবাননেই হাওয়ার্ড নামের এক ইংরেজ সেনা অফিসারের কাছে প্রেমে প্রত্যাখ্যাত এবং রক্ষিতা হিসেবে ব্যবহৃত হবার পর অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে মহিলা একাকী এসে নামলেন মুম্বাইয়ে, নাম নিলেন মেহেরুন্নিসা। এইখানে এক পূর্ব দেশীয় রাজার সেনাপতির সাথে পরিচয় হলো তার, যার নাম মহিউদ্দিন। তাকেই বিয়ে করে সুখের সন্ধান পেতে চাইলেন, কিন্তু বাধ সাধলেন রাজামশাই নিজে। বিদেশী মহিলা, এ তো সাক্ষাৎ স্পাই। ফরমান জারী হলো, হয় একে ছাড়ো, নয় চাকরী ছাড়ো। সেনাপতি মহোদয় অশেষ সাহসের পরিচয় দিয়ে মেহেরুন্নিসাকে রেল স্টেশনে নামিয়ে দিয়ে এলেন, একটি টিকিটও কিনে দিলেন। লেবানিজ এই কন্যা হাল ছাড়ার পাত্র ছিলেন না। আরেকজন রাজকুমারের মন ভিজে উঠলো তাকে দেখে, এইবার হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করলেন তিনি, নাম হলো রাণী মীরা আদিত্যনারায়ণ। চন্দ্রগড়ের রাজকুমারের হেরেম ঠাই পেলেন শেষ পর্যন্ত। চিঠি লিখে বারওয়েল সাহেবকে তার শেষ কৃতজ্ঞতাটি জানাতে ভোলেননি।
এই মহিলার ব্যাপারে কি আপনার জাজমেন্ট? অসৎ, খারাপ, নষ্টা এক মহিলা নাকি সংগ্রামী এবং হার না মানা অসাধারণ শক্ত এক নারীচরিত্র ?
ইংরেজ কন্যা হেলেন গ্রুবার্ট আর বাঙ্গালী যুবক সুরজিত রায়ের ভালোবাসার লড়াই, যেখানে হেলেন মামলা করেছিলেন সুরজিতের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ চেয়ে আর সুরজিতের নব্য তরুণী স্ত্রী তার হাত পাকড়ে অবাক দেখে যেত প্রতিদিনের মোকদ্দমা, হেলেন, যার কাছে এভিডেন্স হিসেবে সংরক্ষিত ছিল সুরজিতের প্রতিটা চিঠি, মামলা জিতেও হেলেন ক্ষমা করে দিয়েছিলেন পুরো জরিমানা, কিংবা হতদরিদ্র নির্যাতিতা বালিকা আরতি রায়ের মুখচাপা অসহায় গল্পগুলো শুধুমাত্র ভারতীয় সমাজে নারীদের অবস্থান এবং পৌরুষের বাগাড়াম্বরের চিত্র আইনের চোখ দিয়ে আমাদের দেখায়। প্রতিটি ক্ষেত্রেই বারওয়েল সাহেব মানবিকতার সর্বোত্তম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়ে আইনের মধ্যে থেকে ন্যায়টাকে বের করে এনেছিলেন। ঐতিহ্যধারী গোল্ড পরিবারের উল্ভারহ্যাম্পটনের জেমস ফ্রেড্রিখ গোল্ড এবং মিস ফিগিনের হৃদয়বিদারক গল্প, যে কিনা পারিবারিক কবরস্থান ছেড়ে দূরে কোথাও নিজের সমাধি কামনা করেছেন এপিটাফে লেখার মতো শুধু বঞ্চনাই আছে বলে, কিংবা গ্রীক নাবিক নিকোলাস ড্রলাসের সাথে জাহাজ কোম্পানীর প্রতারণার মর্মান্তিক পরিণতি অথবা শিক্ষিতা বাঙ্গালী চিকিৎসক ডাঃ শেফালী মিত্রের সাথে সোফিয়া নামক এক তরুণীর মাতৃত্ব নিয়ে লড়াইয়ের চিত্রকল্পগুলো আমাদের চেনাজানা পরিবেশ এবং মানুষগুলো সম্পর্কে এক বিশাল ঝাঁকি দেয়, নিমেষে লন্ডভন্ড হয়ে যায় আমাদের সাজানো দৃষ্টিভঙ্গি আর বিচারবোধ। একজন আইনজীবি কিভাবে বুকে পাথর চেপে রেখে এই সমস্যাগুলোর নিরপেক্ষ সমাধানের কথা চিন্তা করেন, তা সাধারণ কোন মানুষের পক্ষে চিন্তা করাও অকল্পনীয় হয়ে দাঁড়ায়।
শেষ ইংরেজ ব্যারিস্টার বারওয়েল সাহেবের তথাকথিত নেটিভ ইন্ডিয়ানদের প্রতি যে অসীম ভালবাসা ছিল, তার নজীর শংকর তুলে আনেন স্বদেশী বিপ্লবের বন্দী রবীন্দ্র কলিতার গল্পে। মাত্র ষোলো বছরের এ তরুণ থানায় হাজতবন্দী অবস্থায় প্ল্যানমাফিক খুন করেন এক দারোগাকে, স্বদেশী বন্দীদের অত্যাচার করার কারণে যাকে স্বদেশীরা ঘৃণা করেছিল। মিথ্যা সাক্ষ্য, 'ঝোঁকের বশে হত্যা' ইত্যাদি বিবৃতি দিতে অনেক অনুরোধ করা হয়েছিল রবীন্দকে। বাবা-মা একটা আকুতি নিয়েই বারওয়েলের ধর্ণায় পড়ে ছিলেন, জেল হোক তবু ছেলে বাঁচুক। রবীন্দ্র রাজি হয় নি। দৃঢ় কন্ঠে দোষ স্বীকার করে বলেছিলেন, দারোগার এটা পাওনা ছিল। বারওয়েল সাহেব অনেক চেষ্টা করেছিলেন, বড়লাট পর্যন্ত গিয়েছিলেন কিন্তু তাতে কোন লাভ হয়নি। রবীন্দ্র কলিতা ফাঁসিকাঠেই জীবন দেয়। একই ধরণের আরেকটি মামলায় আরেক সত্যবাদী বাঙ্গালী যুবককে বাঁচাতে বরিশাল কোর্টে এসেছিলেন তিনি। জমিজমার মামলাকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হিসেবে দেখিয়ে সিদ্ধি হাসিল করতে যাওয়া হিন্দু গোষ্ঠীর বিপক্ষে রুখে দাঁড়ানো সংখ্যালঘু খ্রিস্টান তরুন নরেন মন্ডলকে তিনি বলা যায় নিজ হাতে ফাঁসির কাষ্ঠ থেকে নামিয়ে এনেছেন। শংকরের কলমের জাদুতে সেই ঘটনা জীবন্ত হয়ে ফুটে ওঠে।

শীর্ষেন্দু'র একটি উপন্যাসের নাম ছিল 'নানা রঙের আলো'। এক সংসারের নানারকম মানুষ যেন একটি হীরের খন্ড, যার একপাশে আলো পড়লে হরেক দ্যুতি ছড়ায়। আমার মতে, 'কত অজানারে'র সার্থক নামকরণ হতে পারতো 'জীবনের নানা রং'। আইনের সাথে সাহিত্যের মিল কোনোকালেই হয়নি, আর এমন সাহিত্য-বিমুখ পরিবেশে বসেই কতভাবে জীবনকে দেখে গেছেন শংকর, আর কি অসাধারণ তার উপস্থাপন ভঙ্গি, আমাদের সামনে তুলে ধরে মানুষের এক অবাক করা স্বরূপ। লেখক বারওয়েল সাহেবের শৈশবের একটি গল্প বলেই বইটির সমাপ্তি টেনেছেন, যা মধ্যে মূলত এক কথায় পুরো বইটাই বিবৃত হয়ে গিয়েছে… লন্ডনে তখন প্রথম এক্স-রে মেশিন আসে। বালক নোয়েল কৌতূহলী হয়ে দেখতে গেলেন, কান্ড দেখে তিনি অবাক। বিস্ময়সুলভ চপলতায় তিনি বলে উঠলেন, এই আলোতে দেহের হাড় পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে! পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক চীনা ভদ্রলোক তাকে বলেছিলেন, Yes my boy; but only bones. Unfortunately it doesn’t show you your heart.
আইনে অধিকার আদায়ের লড়াই বেশিরভাগ সময়েই 'পেশা'র খাতিরে রক্তমাংস ভেদ করে হৃদয় ছোঁয় না। তবু যখন ছোঁয়, তখন জন্ম নেওয়া গল্পগুলো মানবতার ইতিহাসে মুক্তো হয়ে জ্বলে।
'কত অজানারে' সে সময়কার অন্যতম সাহিত্যকর্ম হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। প্রথম বই লিখে সাড়া ফেলে দেওয়া লেখকের নজির দুর্লভ, শংকরের নামে বলা হয়েছিল, "কিছু লেখক প্রথম বইয়ে নিজের সর্বোত্তমটা খরচ করে ফেলে, সবটুকু সার্থকতা একবারেই পেয়ে যান, তারপর হারিয়ে যান সাহিত্যের ময়দান থেকে। শংকর হতে যাচ্ছেন তাদেরই একজন।" কিন্তু সে আশঙ্কার গুড়ে বালি দিয়ে পরের বই 'চৌরঙ্গী' আবারও প্রত্যাশা পূরণে সক্ষম হয়, যেখানে পরবর্তী চাকরিতে দিল্লির এক হোটেল রিসেপশনিস্টের জায়গা থেকে জীবনোপাখ্যান রচনার কাজটি করে গেছেন শংকর। এই নিবেদিত সাহিত্যিক আপন চেষ্টায় উপহার দিয়েছেন একাধিক নন-ফিকশন, বিশের বেশি উপন্যাস, আরও অনেক আত্নজৈবনিক রচনা। তাঁর আসল নাম মনি শংকর মুখার্জি, যে জীবন্ত কিংবদন্তীর প্রথম চাকরি, সাহিত্যের যাত্রা আর 'শংকর' নামধারণ হয়েছিল নোয়েল ফ্রেডরিখ বারওয়েলের হাত ধরেই।