A review by musa
দ্য প্রফেট : The First Muslim by Lesley Hazleton

4.0

এটা শেষে বলতে হতো। শুরুতে বলে রাখি, কারণ আমার ধারণা বইটার প্রতি কিছুটা বিরূপ ধারণা পোষণ করে আসবেন অনেক মানুষ।

আপনার কি এই বইটা পড়া উচিৎ, অথবা না?

(১) আপনি যদি মুসলিম হোন, এবং সীরাত সম্বন্ধে জানাশোনা থেকে, অর্থাৎ পুরো সীরাতুন্নবী পড়েছেন বা পড়েননি কিন্তু ধারণা আছে। তাহলে আপনি এই বইটি পড়তে পারেন। অদ্যাবধি জানার সাথে একটা নতুন দৃষ্টিকোণ যোগ করবে বইটি। আমি বলব, আপনার পড়া-ই উচিৎ, কারণ কিছু প্রশংসনীয় ও যুক্তিযুক্ত দৃষ্টিকোণ এসেছে এই বইয়ে, যা (অন্তত আমার পড়া) সীরাত গ্রন্থে দেখতে পাইনি।
[ যারা Enayet Chowdhury ভাইয়ের রিভিউ ভিডিও দেখেছেন তারা ধারণা রাখবেন কিসের কথা বলছি। ]

(২) আপনি যদি অমুসলিম হয়ে থাকেন এবং রাসুল মুহাম্মাদের (সা.) জীবন সম্বন্ধে জানতে চান, নির্দ্বিধায় পড়তে পারেন। ধর্মীয় শ্রদ্ধাবোধের বাইরে থেকে এটা লেখা হয়েছে, তাই নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি আশা করতে পারেন।
তবে এক্ষেত্রে আমি আব্দুল্লাহ ইবনে মাহমুদ ভাইয়ের এই অনুবাদটাই পড়তে অনুরোধ করব, কেননা লেখিকা কেবলমাত্র ক্রসচেক করার অভাবে কিছু ক্ষেত্রে সাংঘর্ষিক কিছু তথ্য (fact) উল্লেখ করেছেন, অনুবাদক সেগুলো শুধরে দিয়েছেন বইয়ের টেক্সটে অপরিবর্তিত রেখে, টীকা'র সাহায্যে।

(৩) আপনি যদি মুসলিম হোন এবং সীরাত পড়তে আগ্রহী হোন, তাহলে এই বই দিয়ে শুরু না করা-ই উত্তম। একে তো কিছু সাংঘর্ষিক বিষয় আপনাকে দ্বিধায় ফেলতে পারে, দিতীয়ত, ধর্মীয় আঙ্গিকে আপনি যা আশা করতে পারেন সীরাতুন্নবী (সা.) পড়তে যেয়ে, সেটা এই বইয়ে পাবেন না। তাই শুরুর জন্য প্রচলিত কোনো সীরাত পড়া উত্তম।

বইয়ের মূল্যায়ন :

আগের প্যারার প্রথম পয়েন্টে যেটা বলেছিলাম, একটা বাড়তি দৃষ্টিকোণ লক্ষ্য করা যায় এই বইয়ে, এটা একটা ভালো অভিজ্ঞতা ছিল। মুসলিম হিসেবে সীরাত পড়ে এলেও নবী মুহাম্মাদের (সা.) নবী-সুলভ মাহাত্ম্যের বাইরে যে উনি একজন মানুষ হিসেবে বড় হয়েছেন আরবের সামাজিক পরিস্থিতিতে, এই বেড়ে ওঠা ওনার মনন এবং আচরণে কেমন প্রভাব রেখেছে, এটা কিন্তু একজন *মানুষের* জায়গায় নবীকে রেখে খুব বেশি চিন্তা করা হয়নি গতানুগতিক সীরাতে।

জন্মেছিলেন এতিম হয়ে, পাঁচ বছর অব্দি বেদুইনদের মাঝে আরব সন্তান হয়ে বেড়েছেন, নবুয়্যাতের আগ অব্দি মা, দাদা-কে হারিয়ে এক খাদিজা-কে (রা.) পেয়েছেন ভরসার জায়গায়। যখন প্রথম ওহী আসে, কাঁপতে কাঁপতে আশ্র‍য় নিয়েছিলেন স্ত্রীর কাছে, একটা দ্বিধা, অনিশ্চয়তা কাজ করেছিল যে আসলেই যে অভাবনীয় ঘটনা ঘটেছে তা সত্য কি না, তিনি তার যোগ্য কি না। এরপরও দীর্ঘ পথে একে একে উত্তরণ করতে হয়েছিল তাঁর। এই সময়কালে একজন মানুষের মানসিক অবস্থা কেমন হতে পারে পারিপার্শ্বিকের কারণে, লেখিকা একজন সাইকোলজিস্ট হিসেবে সেটা দেখতে চেয়েছেন বাস্তবতার নিরিখে।

অন্যদিকে, মক্কার আর্থসামাজিক অবস্থায় ইসলাম যে কুরাইশদেরকে কেবল আইডোলজিকাল চ্যালেঞ্জে ফেলেনি বরং অর্থনৈতিক/রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জেও ফেলেছিল, লেখিকা সেটাকে নির্দেশ করেছেন সুন্দরভাবে। এই ব্যাপারটাও অন্যান্য সীরাতে লক্ষ্য করিনি।

মোদ্দাকথা, ধর্মীয় মোহ থেকে একজন ধর্মীয় নেতার জীবন সম্বন্ধে জানা, আর ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে একজন ধর্মীয়/রাজনৈতিক নেতা থেকে পরবর্তীতে শাসকের জীবন আলোচনা করা দুইয়ের মাঝের যে ফারাক-টা, এই বইটা পড়তে গিয়ে আমার সামনে উঠে এসেছে।

অনুবাদ এবং সংশোধন প্রসঙ্গে :

লেজলি হেইজেলটন যে ভুলগুলো করেছেন এবং সাংঘর্ষিক তথ্যগুলো উপস্থাপন করেছেন, সেগুলো অন্তত কোনো প্রপাগান্ডার অংশ মনে হয়নি। তবে এই বইয়ের অনুবাদক সেগুলো শুধরে না দিলে, অথবা অন্যান্য রেফারেন্স উল্লেখ না করে দিলে আসলেই পাঠকের বিভ্রান্ত হবার সুযোগ রয়েছে।

দুই জায়গায় একদম মোটা দাগে ভুল করেছিলেন লেখিকা, টাইমলাইনে। সূরা দ্বোহা নাযিলের সময়ে সূরা মুদ্দাসসিরের কথা বলেছেন, আর মুদ্দাসসিরের সময়ে দ্বোহা।

এছাড়াও, ইবনে ইসহাক এবং তাবারির সীরাত অনুসরণ করে অধিকাংশ বর্ণনা দেওয়াতে কিছু ঝামেলা হয়েছে। তার কারণ, 'অমুকে এটা বলেছে বা বলতে শুনেছি' ধরণের অনেক বর্ণনা থাকে, সেগুলোকে যাচাই করে ক্রসচেক করে গ্রহণ করার বিষয় থাকে। সীরাতে ইবনে হিশাম কিংবা আর-রাহীকুল-মাখতুমের মতো সীরাতে তা-ই করা হয়েছে। কিন্তু আগে উল্লেখিত সীরাতগুলোতে এই সব সংশয়পূর্ণ বক্তব্যগুলোও রাখা হয়েছে, অবশ্যই *সংশয়পূর্ণ* লেবেলের তলায়। হাদীসশাস্ত্র সম্বন্ধে ধারণা থাকলে এটা জানবেন, হাসান এবং জয়ীফ (দুর্বল) হাদীসকে গ্রহণ করা হয় না যদি একই ব্যাপারে সহীহ হাদিস থাকে, কিন্তু তাদেরকে বিলোপ করে দেওয়াও হয় না, শাস্ত্রীয় আলচনায় তা থাকে। ইবনে তাবারির সীরাতেও এই সকল রেফারেন্স এভাবেই *সংশয়পূর্ণ* বলে উল্লেখ থাকলেও, লেজলি হেইজেলটন সেগুলোকে একবাক্যে তুলে দিয়েছেন।

অবশ্যই লেখিকা তুলনামূলক হাদীস দেখিয়ে গবেষণাগ্রন্থ লিখতে যাননি, লিখেছেন জীবনীর বর্ণনা। কিন্তু এই তথ্যগুলো পাঠককে বিভ্রান্ত করতে পারে এবং সীরাতের পূর্ব জ্ঞান না থাকলে তা ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে।

এই জায়গায় অনুবাদক টীকা আকারে অন্যান্য রেফারেন্স অথবা সঠিক তথ্যগুলো উপস্থাপন করেছেন, সেটা বইয়ের মূল টেক্সটের ক্ষতি না করেই। অনুবাদকের এই কাজটুকু পাঠকের আন্ডারস্ট্যান্ডিংকে অনেকটা বিপদের হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।

আর এই কাজটা লেখিকা এবং প্রকাশনার অনুমোদন নিয়েই করতে পেরেছেন অনুবাদক।

প্রডাকশন কোয়ালিটি :

পয়লা কথা, দাম নিয়ে একটা আপত্তি দেখতে পাচ্ছি অনেকের মাঝে। এখানে উল্লেখ্য, যেহেতু কপিরাইট কেনা হয়েছে, এতে করেই বইয়ের দাম বেড়ে যাবে জানা কথা।
এর বাইরেও বইয়ের প্রডাকশন বেশ ভালো মানের। মলাট, বাঁধাই, পৃষ্ঠা যথাসম্ভব সবথেকে ভালোটাই দেওয়া হয়েছে মনে হলো।


শেষ কথা :

যা বলে শুরু করেছিলাম, বইটা সম্বন্ধে নানা মতের পার্থক্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ব্যাক্তিগতভাবে আমি এমন কিছু দিক পেয়েছিলাম যেগুলো অদ্যাবধি পড়ে আসা সীরাতগুলোয় পাইনি। তবে লেজলি হেইজেলটনের 'দ্য ফার্স্ট মুসলিম' (অনুবাদে 'দ্য প্রফেট') আদতে সীরাত হিসেবে গ্রহণ করে নেবার জন্য আমার সর্বোত্তম চয়েস না। বইটার সাথে আমার অভিজ্ঞতা উত্তম, এক বসায় একশ' পেইজ করে পড়েছি, ভাল যেমন লেগেছে তেমন 'নতুন কিছু পড়ছি' অনুভব হচ্ছিল। কিন্তু ওটাই কথা, আমার এতদিনের জানার সাথে খানিকটা ভিন্ন স্বাদ যোগ করলো বইটি। এখন যদি *পাথেয়* দরকার হয়, সেক্ষেত্রে এই বইটা আমার অপশন না।

আপনার মত আমাকে জানাতে পারেন, কথা বলতে ভালো লাগবে।

দ্য প্রফেট (মূল নাম : 'দ্য ফার্স্ট মুসলিম')
লেখক : লেজলি হেইজেলটন
অনুবাদক : আব্দুল্লাহ ইবনে মাহমুদ
প্রকাশক : আদী প্রকাশন
প্রকাশকাল : ২০২১
পৃষ্ঠাসংখ্যা : ২৮০
মুদ্রিত মূল্য : ৫৫০ টাকা