A review by musa
সুপুরিবনের সারি by Shankha Ghosh

4.0

সময়ে সব ম্লান হয়ে আসে। ছেলেবেলার মতো মামাবাড়ি যাবার আনন্দ-ও আর এক থাকে না, আর 'নীলু'র মতো যাদের জীবনে আগেভাগেই ছায়া ঘনিয়েছে সময়ের পট-পরিবর্তনে, তাদের সরল চোখে এই পালটে যাওয়া দেখতে বড় বিষাদের, মন খারাপের।

সময়টা সবে দেশ ভাগের পরপর। ভারত স্বাধীন হয়েছে। পূজোর দাদুবাড়ি চলেছে নীলু। এবারের যাওয়া প্রতিবারের থেকে খুব মলিন। আর সব ভাইবোনেরা এবার দাদুবাড়ি যাবে না। দেশেই নাকি নেই ওরা! নতুন জন্মের সাথে দেশ বেড়া টেনে দিয়েছে নিজের মাঝে, এখন সব 'আমাদের দেশ' আর 'তোদের দেশ'। এবারের পূজোও হচ্ছে ছোট করে। প্রতিমায় সেনাপতি কার্তিক হবে নাকি বাবু কার্তিক, সেসব নিয়ে আবদার করার যো নেই। পাশের বাড়ির হারুন রোজ আসতো পূজোয়, সপ্তমী থেকে দশমী একসাথে কাটতো। এবার হারুণের পাত্তা নেই। হারুনের বাড়ির বড়দের মুখেই শুনেছিল, জিন্না সাহেব নাকি আশ্বাস দিয়েছেন, "একদিন এই সব জমি, বাড়ি আমাদের হবে"। আমরা, ওরা- কারা এসব? এতদিন তো এমন ছিল না?

বইটা আমি পড়ছিলাম মামাবাড়ির উঠানে বসে। ভোর হয়ছে, ঘরের চালার ওপর দিয়ে রোদ পড়েছে সামনে টিনের বেড়ার গায়ে। বেড়া। সামনে, ডানে। দুইবার ভাগ হয়ে গেছে ছোট্ট উঠানটা, আমার শৈশবের স্মৃতিতে যেটা অখন্ড ছিল। দুই বাড়ির ছেলেমেয়ে পূর্ণিমার রাতে বউছি খেলেছি উঠোনজুড়ে। ধান মাড়াই আর খড় শুকানোর কাজ হতো যখন পুরো উঠানে, এ-মাথা ও-মাথা গড়াগড়ি দিয়ে গা লাল করে ফেলতাম ছোটরা। দুই বাড়ির মাঝে প্রথম বেড়া উঠলো, এক উঠোনে দাঁড়িয়ে মুখ দেখা বন্ধ। সময়ে, সেই এক ঘরেও ভাগ হলো। ছোটবেলায় যা ছিল বিচরণের সীমা, এখন সে উঠানে দাঁড়ালে মুখের ওপর বেড়া দেখতে পাই। মানুষ কি ভাগজোক ছাড়া থাকতে পারে না? হোক সেটা একটাই দেশ দু'বার ভাগ করা, অথবা এক উঠানের তিন ভাগ।

সারল্য নিয়ে এসবেই তাকিয়েছেন শঙ্খ ঘোষ। নীলু'র চোখে তার মায়া-মাখা গ্রাম, প্রতি পূজোর স্মৃতি, পাড়ার ছেলেরা বদলে যাবার ছবি দেখে, নিজেদের মনেও কত সব ছেড়ে আসার বেদনা জেগেছে। শৈশবে আর ফেরা যাবে না তো, নেই পথ নেই হারিয়ে গেছে সে দেশ।